বাংলা সাহিত্যে অরণ্য ভ্রমণ
একটা দৃশ্য মনে করার
চেষ্টা করুন। সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্ট বিশেষ চরিত্র নকুড়বাবু আর তাঁর সাহেব সহযাত্রী
ব্লুমগার্টেন ব্রাজিলের ঘন জঙ্গলের উপর দিয়ে হেলিকপ্টারে উড়ে যাচ্ছেন। চতুর্দিকে
উঁচু উঁচু গাছে ভরা রেনফরেস্টের মাঝে হঠাৎ যেন সূর্যের আলোর প্রতিফলনে চকচক করে
উঠল সোনার দেশ ‘এল ডোরাডো’। লোভ ও লালসায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ব্লুমগার্টেনের
মুখ-চোখ। কাট্!
এবার অন্য দৃশ্য। না, এটা
সত্যজিতের ছবি নয়। তিনি পয়সা ও টেকনোলজির অভাবে প্রফেসার শঙ্কুকে নিয়ে কোনও সিনেমা
করতে পারেননি। কিন্তু স্পিলবার্গ দেখিয়ে গেছেন তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘দ্য জুরাসিক
পার্ক’এ আমাজনের দু-পাড় ঘেঁসে ব্রাজিলের সেই ঘন জঙ্গল। মেডিটেরানিয়ান ব্রাজিলের
গভীর অরণ্যের ঠিক মাঝখানে নেমে এল হেলিকপ্টার, যেখানে প্রাগৈতিহাসিক
জন্তুজানোয়ারদের নিয়ে তৈরি হয়েছে এক অভূতপূর্ব মুক্তাঞ্চল চিড়িয়াখানা- কি ভয়ঙ্কর
সুন্দর সে দৃশ্য।
এখন আমরা ঘরে বসেই এসব
দেখতে পাই স্টার ওয়ার্ল্ড, এইচ-বি-ও, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ডিসকভারি- এসব
চ্যানেলে। কিন্তু অবাক লাগে যখন পড়ি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’।
বিহারের পূর্ণিয়া অঞ্চলের লবটুলিয়ার সাধারণ ও নিতান্তই দিশি জঙ্গলের অপরূপ
সৌন্দর্য নিয়ে এক অবিশ্বাস্য মানবিক কাহিনী বা ‘অপরাজিত’ উপন্যাসে মধ্যভারতের
অরণ্যে অপুর এক নতুন জীবনের সূচনা - চাঁদনী রাতে অরণ্যের মাঝখান দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে
যাওয়ার সেই চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা। তখন মনে হয়, এ যেন গল্প নয়, চোখের সামনে যেন ঘটে
যাচ্ছে, এমন জীবন্ত সে বর্ণনা। আফ্রিকা না গিয়েই তিনি লিখেছেন ‘চাঁদের পাহাড়’,
উগান্ডার রিখ্টারস্ভেল্ড পাহাড়ে বাংলার ছেলে শংকরের দুঃসাহসী অভিযান। বিখ্যাত
ভ্রমণকারীদের অভিজ্ঞতা অনুসরণে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক সংস্থান এবং
প্রাকৃতিক দৃশ্যাদির যথাযথ বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। ঠিক আদর্শ ভ্রমণকাহিনী না হলেও
রহস্য-রোমাঞ্চে ভরা এ বইটি বাংলা সাহিত্যের অরণ্য সম্বন্ধে এক সর্বকালের সেরা
কিশোরোপযোগী ক্লাসিক হিসেবে পরিগণিত হবে।
অরণ্য, বন্যজন্তু ও শিকার
নিয়ে ভ্রমণসাহিত্য ইংরাজিতে বিরল নয়। যুগে যুগে দুঃসাহসী ইউরোপিয়ান যুবকেরা
ভাগ্যানুসন্ধানে বা নিছক অজানা দেশ আবিষ্কারের নেশায় ছুটে বেড়িয়েছেন অন্ধকার
মহাদেশ আফ্রিকায়, আবিষ্কৃত হয়েছে মহাদেশের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কিলিমানজারো বা বিশ্বের
সর্বোচ্চ জলপ্রপাত ভিক্টোরিয়া। তবে ভারতের বন্যজীবন নিয়ে দুটি ক্লাসিক সাহিত্যের
কথা আমার মনে পড়ছে- কিপলিং-এর ‘জাঙ্গল বুক’ আর জিম করবেটের ‘ম্যান-ইটার অফ
কুমায়ুন’। তবে এগুলোও ঠিক ভ্রমণসাহিত্য নয়।
না, বাংলার
ভ্রমণ-সাহিত্যের, বিশেষত: অরণ্য-ভ্রমণ নিয়ে প্রথম রসোত্তীর্ণ রচনা বোধহয়
বঙ্কিমচন্দ্রের বড়ভাই সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’। এই উপাখ্যানে অরণ্য-বনানী
আছে, বনচর আদিবাসিদের সরল জীবনযাত্রা, তাদের সাহসিকতা, জীবন সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা
আর আছে লেখকের কিছু বিখ্যাত উপলব্ধি, যেমন- ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা
মাতৃক্রোড়ে’, ‘বিদেশে বাঙালিমাত্রেই সজ্জন’, বা ‘পিনাল কোড যত ভাল হয় (অপরাধীর),
সাহসও ততই অন্তর্হিত হয়’ ইত্যাদি।
বুদ্ধদেব গুহ
|
তবে সঞ্জীব-বিভূতিভূষণের
পরে বাংলার অরণ্যভ্রমণ সাহিত্য নিয়ে সত্যিসত্যিই যিনি যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেছেন,
যাঁর একের পর এক রচনায় ফুটে উঠেছে আফ্রিকা, সেশ্যেলস ও ভারতের দুর্গম ও
শ্বাপদসংকুল যত অরণ্যের ভয়ংকর সৌন্দর্যের চাক্ষুষ ধারাবিবরণী, তিনি আর কেউ নন,
পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, সুপুরুষ, শিকারী, সুগায়ক ও সর্বোপরি সুসাহিত্যিক
বুদ্ধদেব গুহ। তাঁর ঋজু বোসকে চেনে না এমন কিশোর-কিশোরী বঙ্গভাষীদের মধ্যে বিরল।
যদিও আজকের বাবা-মারা সগর্বে ঘোষণা করেন- ‘আমার ছেলেমেয়েরা বাংলা পড়তেই জানে না’, তবু
তাঁরা স্বীকার করবেন যে টেনিদা-ঘনাদা-ফেলুদা-ঋজুদার স্বাদ না পাওয়া বাঙালী
কৈশোর-জীবন কতটা অসম্পূর্ণ- তারা জানে না তারা কি হারিয়েছে। তবে শুধু ঋজু বোস সহ
চার মূর্তি (ঋজু-রুদ্র-তিতির-ভটকাই) ছাড়াও বুদ্ধদেবের গল্প-উপন্যাস মানেই তার
কোথাও না কোথাও অরণ্য বনানীর শ্যামল ছোঁয়া থাকবেই, মাধুকরী-কোজাগর-বাবলি-একটু
উষ্ণতার জন্যে, সে যে বইই হাতে তুলি না কেন।
আফ্রিকার জঙ্গলের সাথে
বাঙালির পরিচয় ঘটিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ তাঁর ‘চাঁদের পাহাড়’এ। এবার দক্ষিণ-পূর্ব
আফ্রিকার তাঞ্জানিয়ার বিখ্যাত দুই রিজার্ভ ফরেস্ট সেরেঙ্গটি ও রুআহায় ঋজু বোসের
দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারের সাথে রুদ্ধশ্বাস ভ্রমণ-কাহিনী ‘গুগুনোগুম্বারের দেশে’ ও
‘রুআহা’ লিখে সুদূর অন্ধকার মহাদেশকে বাঙালির হৃদয়ের কাছে নিয়ে এলেন বুদ্ধদেব গুহ।
‘রুদ্ধশ্বাস ভ্রমণকাহিনী’ কথাটা একটু বেখাপ্পা শোনাচ্ছে, না? কি করি, বইদুটো পড়ার
পর যদি কোনও পাঠকের মাথায় আর কোনও উপযুক্ত বিশেষণ আসে, জানানোর অনুরোধ রইল।
ভ্রমণ সাহিত্যের বিশেষত্ব
কি, তার সার্থকতা কোথায়, আর তার নিরিখে বাঙ্গালি-মানসে বুদ্ধদেব গুহর স্থান ও মান
কতটা, আসুন এবার সে কথাটা একটু ভাবা যাক। ‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি...’
ইত্যাদি লিখে কবিগুরু ভ্রমণকাহিনী পাঠের একটা বিরাট উপযোগিতার কথা লিখেছেন বটে।
তবু আরেকটু ভেবে দেখতে ক্ষতি কি? ভেবে দেখুন তো ভারতবর্ষের অংশ হিসেবে স্বাধীনতার
আগে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সম্বন্ধে আমাদের ধারণা কি ছিল?
কালাপানি-দ্বীপান্তর-নৃশংস সেলুলার জেল। তারপর ১৯৪৩-এ জাপানীদের সাহায্যে আজাদ
হিন্দ বাহিনীর দ্বারা দ্বীপদুটির মুক্তি- নেতাজি তাদের নতুন নামকরণ করলেন ‘শহীদ’ ও
‘স্বরাজ’ দ্বীপপুঞ্জ। তারপর সেলুলার জেলের সমাপ্তি, পঞ্চাশ সালে দ্বীপপুঞ্জের
স্বাধীন ভারতে অন্তর্ভুক্তি ও তামিল-তেলেগু মৎস্যজীবী আর মূলত: পূর্ব পাকিস্তান
থেকে আসা শরণার্থীদের নিয়ে দ্বীপগুলির পুনর্বাসন- এই ছিল তাদের ইতিহাস। ইতিমধ্যে
প্রকাশিত হল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাকাবাবু সিরিজের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘সবুজ দ্বীপের
রাজা’ যার থেকে ১৯৭৯ সালে ছোটদের জন্যে একটি সিনেমা তৈরি করলেন খ্যাতনামা নির্দেশক
তপন সিংহ। ছবিটি এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করে যে তার পরের বছর থেকেই আন্দামান
বাঙালীদের কাছে একটি প্রিয় ভ্রমণকেন্দ্রের মর্যাদা পায়। ঠিক ততটা না হলেও কিছুটা
অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল বুদ্ধদেব গুহর ‘ঋজুদার সঙ্গে সেশ্যেলসে’ গল্পের পর, বাঙালী
(অপেক্ষাকৃত বিত্তশালী) ভ্রমণকারীরা জানতে পারল একটা নতুন ভ্রমণ-তীর্থ সম্বন্ধে।
বুদ্ধদেব গুহের
অরণ্য-বনানী নিয়ে আজীবন লিখে যাওয়া অসংখ্য গল্প-উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করার আগে তাঁর
এই অরণ্য-প্রীতির পটভূমিটা একটু ভাল করে খতিয়ে দেখা দরকার। বিভিন্ন রচনার ভূমিকায়,
তাঁকে নিয়ে করা তথ্যচিত্রে তিনি বারবার বলেছেন যে তিনি জীবনভর শুধু নরম সাদা পটে
আঁকতে চেয়েছেন মানব-প্রেমের গল্প, যার পশ্চাৎপটে থাকবে শুধু কোমল রঙের প্রতিফলন আর
গভীর বিশ্বাস। এই কোমল পটভূমিটা হল শুদ্ধতার প্রতীক অরণ্য আর বিশ্বাসের মূর্তরূপ
বন্য জন্তু যারা বিশ্বাসঘাতকতা শব্দটি শেখে নি। এই চেতনাটা নিঃসন্দেহে এসেছে তাঁর
ছেলেবেলা হাজারিবাগের মত জায়গায় কাটানোর ফলে। সেখানকার পাহাড়ি বনভূমি, চারপাশের
সবুজ আর নীলের সমারোহের মাঝে থাকায় একটা প্রকৃতিপ্রেমের প্রবণতাই শুধু গড়ে ওঠেনি,
‘ভালবাসা’ কথাটা তার প্রশস্ততর রূপে স্থান পেয়েছিল তাঁর মনের মণিকোঠায়। ‘সুদূর
সকাল’ উপন্যাসে প্রয়াতা মাকে লেখা তাঁর দীর্ঘ চিঠির বয়ান যদি সত্যই হয়, তাতে জানা
যে শুধু মায়ের থাকার জন্যেই তিনি ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জে একটা বাড়ি কিনেছিলেন, মায়ের মারা যাবার পর সেটা খালি পড়ে থাকত বলে পরে বেচে
দেন। এই বন্য আধা-শহরের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ আসলে কিন্তু
একটি কোমল-শাশ্বত প্রেমের কাহিনী। কিন্তু এই গল্পই বাঙালীকে চেনাল একটি একটি
অনাস্বাদিত পর্যটনস্থলকে। ‘ঋজুদার সাথে ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জে’ গল্পে তার উল্লেখ আছে।
এভাবেই ঋজুদার হাত ধরে বা অন্যভাবে এসেছে মণিপুর অঞ্চলের কাঙ্গপোকপি- অন্যত্র বলতে
বাবলি উপন্যাস মনে পড়ছে, উড়িষ্যার অরাটাকিরি, নিনিকুমারী, পুরানাকোট আর জুজুমারা,
আন্দামানের ডেভিলস আইল্যান্ড শিকার আর শিকার-কাহিনীর ছলে। আমাদের ঘরের কাছেই
সিমলিপাল ন্যাশনাল ফরেস্টের কাছে ‘বাংরিপোসি’ ও যে এত সুন্দর একটি প্রেমকাহিনির
পটভূমি হতে পারে তাও আমরা জেনেছি তাঁর কাছ থেকেই। তাঁর সম্ভবত: সর্বাধিক সমাদৃত
‘মাধুকরী’ উপন্যাসেও অরণ্য এক বড় ভূমিকাতে রয়ে গেছে। নর-নারীর প্রেমে শারীরিক
মিলনের ভূমিকা খুব মর্মস্পর্শী ভাবে বিধৃত তাঁর কাহিনীগুলিতে, সেই রকম বেশ কিছু
ঘটনাও ঘটে গেছে জঙ্গলের আদিম পরিবেশে।
বুদ্ধদেব গুহ ভ্রমণকাহিনী
লিখেছেন অজস্র, তারমধ্যে ‘ঋজুদার সঙ্গে বক্সার জঙ্গলে’ গোছের দু’একটা ছাড়া
বেশিরভাগই প্রায় এমন কিছু শিকারের গল্প, যাতে গল্পের থেকে বেশী জঙ্গলের ও জংলি
মানুষদের বর্ণনা, আর বীররস থেকে জীবজন্তুদের প্রতি মমতা আর ভালবাসাই প্রকাশ পেয়েছে
বেশী। কিশোর প্রজন্মের অতি-প্রিয় ঋজুদাও তো দেখি ওই একই আদর্শে দীক্ষিত- ঠিক যেন
জিম করবেট, শার্লক হোমস আর ডেভিড লিভিংস্টোনের মিলিত সংস্করণ অথচ তাঁর বাঙালী
মৌলিকতাটুকু একশোভাগ বজায় রেখে। এ ধরণের উপন্যাসের পাঠকসংখ্যা ছিল একেবারেই সীমিত,
কারণ মানবিকতার দায়িত্ব বজায় রাখতে গিয়ে অভিযানের রুদ্ধশ্বাস সাসপেন্স বিঘ্নিত
হয়েছে মাঝে মাঝেই যখন শিকারকে হাতের মুঠোয় পেয়েও ঋজুদা বা নাজিম সায়েব (ঋজুদা ও
ডাকু পিপ্পাল পাঁড়ে) ছেড়ে দিয়েছেন হয়ত শুধুমাত্র তাদের স্পিসিসকে অবলুপ্তির হাত
থেকে রক্ষা করতে। বুদ্ধদেবের কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি এখানে কোনও আপোষ করেন নি,
ঋজুদাকে ঋজুদার মতই থাকতে দিয়েছেন। তাঁর কিশোর পাঠক তো আর শিশু নয়, তারা এই
জিনিষটা ঠিকই উপলব্ধি করতে পেরেছে যে বাঘকে হাতের মুঠোয় পেয়েও ছেড়ে দেবার জন্যে
কলিজা লাগে- এ কিন্তু ভীরু দুর্বলের কর্ম নয়। রুদ্রের কলম এই আবেগটাকে বেশ ভালই
ফুটিয়ে তুলেছে। এই প্রসঙ্গে একটা তুলনা টানা যেতে পারে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের
‘কাকাবাবু’র সাথে। তাঁর ও সন্তুর কাণ্ডকারখানা একটু অতিমানবীয়, তবে সুনীলের target audience যেহেতু অপেক্ষাকৃত
কমবয়েসিদের দল, তাই এই ব্যাপারটা মেনে নেওয়া যায়। আর প্রসঙ্গ এলো বলেই বলছি,
সদ্যপ্রয়াতা সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টাচার্যের বছর দুয়েক আগের শারদীয়া আনন্দমেলায়
মিতিনমাসীকে নিয়ে লেখা কিশোর গোয়েন্দা কাহিনী ‘টিকরপাড়ার ঘড়িয়াল’ উড়িষ্যার
পর্বত-বনানীসংকুল পম্পাসার, সাতকোশিয়া গর্জ, টিকরপাড়া, আঙুল, পুরানাকোট নিয়ে যে
একটা অন্যতম সেরা ভ্রমণকাহিনীর মধ্যেও পড়ে, তা বলাই বাহুল্য। আমাদের ও আমাদের
ছেলেমেয়েদের দুর্ভাগ্য যে তারা টুপুর-মিতিনমাসীকে আর দেখতে পাবেনা আনন্দমেলা বা
কোনও বইয়ের পাতাতেই।
বুদ্ধদেব গুহর
ভ্রমণকাহিনীতে গল্পের অভাব কোনও কালেই ছিল না, তবু তার মধ্যে সাপ-লুডো খেলার মত
রুদ্ধশ্বাস অ্যাডভেঞ্চারের বাতাবরণের অভাবটা বুদ্ধদেব হয়ত ক্রমেই টের পান। তারই
ফলস্বরূপ আমরা উপহার পাই ‘গুগুনোগুম্বারের দেশে’- তাঞ্জানিয়ার সেরেঙ্গটি ফরেস্ট ও
গোরোংগোরো আগ্নেয়গিরির ভ্রমণকাহিনী- সাথে ঋজুদা-রুদ্রর দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চারের
গল্প। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি ঋজুদাকে এক দুঃসাহসিক কাজের দায়িত্ব দেয়,
তাঞ্জানিয়ার ঐ অঞ্চলের চোরা শিকারীদের খুঁটিনাটি বিবরণ সংগ্রহ করার দুঃসাধ্য
কার্যভার। অপরাধীরা এতটাই চতুর আর সংগঠিত ছিল যে তারা সর্ষের মধ্যেই ভূত ঢুকিয়ে
দেয়। ঋজুদার লোকাল গাইড ভুষুণ্ডা দেখা যায় আসলে শত্রুপক্ষের চর। বারে বারে
প্রাণসংশয়ের মধ্যে থেকে ‘নাইরোবি’ নামে এক মাসাই সর্দারের বদান্যতায় শেষ মুহূর্তে
ঋজুদা মুমূর্ষু অবস্থায় রক্ষা পান। ভুষুণ্ডা ঋজুদার তল্পিবাহক টেডিকে খুন করে
পালায়। সে যাত্রায় প্রাণ ফিরে পেলেও বিশ্বাসঘাতক ভুষুণ্ডাকে শাস্তি দেওয়ার কথাটা
কিন্তু ভুলতে পারে না রুদ্র বা ঋজুদা।
এই ঘটনার কয়েকমাস পরে
ঋজুদারা যখন কলকাতায়, হঠাৎ খবর পাওয়া গেল যে ভুষুণ্ডাকে নাকি দেখা গেছে পূর্ব
তাঞ্জানিয়ার আরুশায়। যাত্রার তোড়জোড় শুরু হয়। এবারে একটি অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে।
ঋজুদার গল্পে তিতির নামে একটি স্মার্ট, সুন্দরী ও সাহসী কিশোরী এসে পড়ে। সে
কলকাতার বাঙালী হলেও বন্দুকে তার নিশানা অব্যর্থ, ফ্রেঞ্চ বলতে পারে গড়গড় করে,
এছাড়া আফ্রিকার সোয়াহিলি ভাষাও খানিকটা জানে। এবার তাদের দল বেড়ে দাঁড়ায় তিনজনের।
এরপর আবার তাঞ্জানিয়া, এবার ‘রুআহা’র জঙ্গলে। তারপর কিভাবে তিনজনের মিলিত উদ্যোগে
ধ্বংস হল ভুষুণ্ডা সমেত পোচার বাহিনী- সে এক রুদ্ধশ্বাস কাহিনী। দেখা গেল, যে
ঋজুদা জীবজন্তুদের খুব প্রয়োজন না পড়লে মারেন না, নৃশংস খুনী ভুষুণ্ডা ও তাদের
দলবলকে মারতে তাঁর হাত একেবারেই কাঁপেনি, অবশ্যই এক্ষেত্রেও তিনি অকারণে কাউকেই
মারেন নি।
‘গুগুনোগুম্বারের দেশে’
আর ‘রুআহা’ উপন্যাস দুটি বাংলা কিশোর সাহিত্যের একটি মাইলস্টোন হয়ে থাকবে
ভ্রমণ-অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে, যদিও এই ধারার স্রষ্টা-জনক হলেন বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়। বুদ্ধদেব যে কটি গল্প লিখেছেন তার প্রতিটি সেসব জায়গায় ভ্রমণের
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে, আর বিভূতিভূষণ চাঁদের পাহাড় লিখেছেন আফ্রিকা না গিয়েই,
তাই তাকে ঠিক ভ্রমণ-উপাখ্যান বলা হয়ত সঙ্গত হবে না। তাই বলে তাঁর কৃতিত্বকে কোনও
অংশেই খাটো করে দেখান নি বুদ্ধদেব গুহ। ‘রুআহা’ গল্পে তিনি তিতিরের মুখে বলিয়েছেন-
‘তুমি (রুদ্র) আমাকে কি ভাব বল তো?
আফ্রিকাতে সশরীরে আগে আসিনি বলে আমার কিছুই বুঝি জানতে নেই? বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
তো একবারও না এসেই চাঁদের পাহাড় লিখেছিলেন। তুমি কি পঞ্চাশবার এখানে এসেও ঐরকম
একটি বই লিখতে পারবে?”
না, পারবে না। পারা যায়
না। সবাই পারে না। আর বিভূতিভূষণরা একবারই জন্মান তাঁদের এই ভাল-লাগার, ভালবাসার
পৃথিবীতে। কবিতা লিখলে হয়ত রবীন্দ্রনাথের মত তিনিও বলতেন-
“আবার যদি ইচ্ছা কর আবার আসি ফিরে
দুঃখ-সুখের ঢেউ খেলানো এই নদীরই তীরে”।
দুঃখ-সুখের ঢেউ খেলানো এই নদীরই তীরে”।
বুদ্ধদেব গুহও বারবার
জন্মান না। তবে আমাদের অসীম সৌভাগ্য, তিনি আমাদের মধ্যেই আছেন যদিও আমি নিশ্চিত যে
তাঁর অশেষ প্রতিভার পরিপূর্ণ প্রকাশ একজন্মে সম্ভব নয়। বিভূতিভূষণ তাঁর অনুপ্রেরণা
হলেও তিনি কিন্তু একেবারেই অন্য পথের পথিক। বিভূতিভূষণের অরণ্য যেন স্বর্গের
সুষমামণ্ডিত এক দেবী! অপর দিকে অরণ্য বুদ্ধদেব এর কাছে যেন এক রক্তমাংসে গড়া
মানবী। একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও অরণ্য-প্রকৃতিকে কিভাবে অনুধাবন করেছেন বুদ্ধদেব,
বর্ণনা করার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারছি না-
“বসন্তের মিষ্টি রোদে চারদিকের মাঠ, টাঁড়,
প্রান্তর সব ভরে গেছে। এদিকে ওদিকে পাহাড়ে-ঢালে একটি দুটি করে অশোক শিমূল আর
পলাশের ডালে ডালে পহেলী ফুল তাদের ফুটি ফুটি লজ্জায় লাল মুখ বের করেছে সবে। আর
মাসখানেকের মধ্যেই চারদিকে লালে লাল হয়ে যাবে। বনবাংলোর হাতার সব ক’টি কৃষ্ণচূড়া
আর রাধাচূড়ার ডালে লাল হলুদ বাগুন সামিয়ানা বাঁধবেন প্রকৃতি নিজ হাতে। কোনও
কামার্তা অবুঝ যুবতীর শরীর মনের সব ঝাঁঝ ঠিকরে বেরুবে তখন প্রকৃতির মধ্যে থেকে।
তারপর প্রেমের বারি নিয়ে আসবে বর্ষা। বসন্তে ঋতুমতী প্রকৃতি বর্ষার ঔরসে অভিষিক্ত
হয়ে সুধন্যা করবে নিজেকে। তখন মাটিতে লাঙ্গল দেবে তারা। ক্ষেতে লাঙ্গল দেওয়ার
মধ্যে বোধহয় একধরণের প্রাগৈতিহাসিক যৌনতা আছে, যেমন শেক্স্পিয়ার বলেছিলেন-
‘Caesar ploughed Cleopatra’…..।” (কোজাগর)
তিনি নাস্তিক না হলেও
ধর্মীয় গোঁড়ামি তাঁর মধ্যে একেবারেই নেই, তবু তাঁর গল্পের নায়কেরা জীবনানন্দের মতই
বারবার বলেছে- ‘আবার আসিব ফিরে’। যদিও তিনি সম্প্রতি আর লিখছেন না, তবুও তিনি
ইতিমধ্যেই ঋজুদা-রুদ্র-তিতির-ভটকাই ফ্যান ক্লাব ও তাঁর মুগ্ধ পাঠকমণ্ডলীর জন্য যা
সম্ভার রেখে গেলেন তা বঙ্গসাহিত্যের এক বিশেষ সম্পদ। তাদের সকলের তরফ থেকে তাঁর
সুস্থ ও দীর্ঘজীবন কামনা করে এখানেই শেষ করি।
লেখক পরিচিতি - জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিহার
(অধুনা ঝাড়খন্ডের) ধানবাদ কয়লাখনি ও শিল্পাঞ্চলে, সেখানে 'নানা জাতি, নানা মত,
নানা পরিধান' হলেও বাংলা ও বাঙালিদের প্রাধান্য ছিল একসময়। ১৯৮২ সালে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে পেট্রোলিয়াম লাইনে চাকুরী, বর্তমানে
কুয়েত অয়েল কোম্পানিতে কর্মরত। শখ-গান-বাজনা আর একটু-আধটু বাংলাতে লেখালেখি।
কিছু লেখা ওয়েব ম্যাগাজিনে (ইচ্ছামতী, আদরের নৌকো ও অবসর) প্রকাশিত ।
0 coment rios: